logo
ads

ঈদে মিলাদুন্নবি উদযাপন: মুসলমানদের নয়, খ্রিস্টানদের কালচার

লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

প্রকাশকাল: ৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:৩১ পি.এম
ঈদে মিলাদুন্নবি উদযাপন: মুসলমানদের নয়, খ্রিস্টানদের কালচার

ছবি: সংগৃহীত

মিলাদ মানে কি?

মিলাদ শব্দটি আরবী। যার অর্থ হল জন্ম। সুতরাং মিলাদুন্নবি মানে হল নবির জন্ম।

একজন সাধারণ মুসলমানও বুঝবেন জন্মদিন উদযাপনের কোন বিষয় নয়। এটি কেবলি আলোচনার বিষয় হতে পারে। এটি পালনীয় বিষয় হলে রাসূল (সা.) নিজেই তা পালন করে দেখাতেন। সাহাবাগণ যারা সবচেয়ে বেশি আশেকে রাসূল ছিলেন। নবীজী (সা.) এর প্রতি মুহাব্বাতের চূড়ান্ত পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে যারা অকাতরে জীবন বিলিয়েছেন। সন্তান এতিম করেছেন। স্ত্রী বিধবা করেছেন। পরিবার, সমাজ, অর্থ, বিত্তবৈভব সবই বিসর্জন করেছেন নবীজী (সা.)-এর মোহাব্বতে। কিন্তু সেসব সাহাবাগণ কেন নবীজী (সা.)-এর জন্মদিন পালন করেননি? কেন, আবু বকর (রা.), ওমর (রা.), উসমান (রা.) ও হযরত আলী (রা.)-এর মতো খুলাফায়ে রাশেদীনের জমানায় এ ঈদ উদযাপিত হয়নি?

এসব কি প্রমাণ করে? এটি উদযাপনের বিষয়? যদি এটি সওয়াবের বিষয় হতো, তাহলে সাহাবায়ে কেরামগণ কেন এটি পালন করেননি? কেন তাবেয়ীগণ পালন করেননি? কেন তাবে-তাবেয়ীগণ পালন করেননি?

কেন এ ঈদের কথা কুরআন, হাদীস এবং ফিক্বহের কিতাবে লেখা হয়নি?

যা পরিস্কার প্রমাণ করে এটি একটি পরিস্কার বিদআত।

খ্রিস্টানদের থেকে ধার করা এ কথিত ঈদের অনুষ্ঠান খ্রিস্টানরা তাদের নবির জন্মদিন উপলক্ষে পালন করে থাকে। কিন্তু তাদের নবির সীরাত আমলে নেয় না। অর্থাৎ তারা মিলাদুন্নবির প্রবক্তা। কিন্তু তাদের নবির সীরাতুন্নবীর প্রবক্তা নয়। কারণ সীরাত হল নবির আদর্শ মেনে  চলা। নবির বাতানো পথে নিজেকে সঁপে দেয়া। যদি খ্রিস্টানরা তাদের নবির সেই সীরাতকে মেনে নিত, তাহলে তারা আর খ্রিস্টান থাকতে পারতো না, হয়ে যেতো মুসলমান। আর মদ, জুয়া, যিনা ইত্যাদিতে মত্ত থাকতে পারতো না; হয়ে যেতো খাঁটি মুসলমান।

খেয়াল খুশির জীবন পরিহার করে খাঁটি মুসলমান হবার ভয়ে ওরা তাদের নবির সীরাত বাদ দিয়ে পালন করে মিলাদ তথা নবির জন্ম দিবস।

ঠিক একই পদ্ধতিতে কতিপয় নামধারী মুসলমান নবীর সীরাত পালন না করে খ্রিস্টানদের মত মিলাদুন্নবি পালনে মত্ত। যাদের না চেহারায় আছে নবির সুন্নত, না পোশাকে নবির সুন্নত, না আখলাকে নবির সুন্নত। কিন্তু সেজে বসে আছে বিশাল আশেকে রাসূল।

আমাদের নবীজী (সা.) তাঁর ২৩ বছরের নবুওয়তী জীবনে যে সব বিষয়ের জন্য মার খেলেন, রক্তাক্ত হলেন, সেই সীরাত রেখে একটি অযথা ও বিদআতি কর্ম মিলাদুন্নবি পালন করা খ্রিস্টানদের বড়দিন পালনের মত ধোঁকাবাজি ছাড়া আর কিছু নয়।

মিলাদুন্নবি অস্বীকারকারী কেউ নয়, কিন্তু সীরাতুন্নবি অস্বীকারকারীর অভাব নেই!

মিলাদুন্নবি মানে হলো নবির জন্ম। নবির জন্ম কেউ অস্বীকার করে না। আরবের মুশরিকরাও নবীর মিলাদকে অস্বীকার করেনি। অস্বীকার করে না কোন কাফির, মুশরিক বা নাস্তিকও। (*) কিন্তু তারা কেউ নবীজী (সা.)-এর সীরাতকে মানে না।

তাই মিলাদুন্নবির মাঝে কোন ফযিলতের বিষয় নেই। ফযিলতের বিষয় হলো সীরাতুন্নবি পালনে।

মিলাদুন্নবিতে খুশি সবাই। আরবের মুশরিকরাও খুশি ছিল।

রাসূল (সা.)-এর জন্মে যেমন পৃথিবীর সকল মুমিন খুশি। খুশি পৃথিবীর সকল সৃষ্টিজীবও। তেমনি খুশি ছিল আবু লাহাবও। খুশি ছিল আবু তালেবও। কিন্তু নবীর জন্মের এ খুুশি তাদের জান্নাতে নিয়ে যেতে পারেনি। যেহেতু তারা নবীজী (সা )-এর সীরাতকে নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করেনি।

তাই নবির জন্মে খুশি হওয়া মানেই জান্নাতে যাবার মাধ্যম মনে করা আহম্মকি ছাড়া কিছু নয়। যতক্ষণ না নবীজী (সা.)-এর সীরাত তথা আনীত জীবন বিধান নিজের জীবনে বাস্তবয়ান করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এ ঈদে মিলাদুন্নবি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।

তাই মিলাদ নিয়ে মাতামাতি নয়, নবীজী (সা.)-এর সীরাত নিজের জীবনে আঁকড়ে ধরতে হবে।

আমাদের প্রিয় নবীজী (সা.)-এর মৃত্যু দিবসে এ কোন ইবলিসী আনন্দে মেতে ওঠে কথিত আশেকে রাসূলরা?

অধিকাংশ ঐতিহাসিক এবং সীরাত বিশেষজ্ঞগণ এ কথার উপর একমত যে, ১২ই রবিউল আউয়াল তারিখে রাসূল (সা.) এ দুনিয়া থেকে আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যান।

যে সব ঐতিহাসিক এবং সীরাত গবেষকগণ এ মত পোষণ করেন, তাদের কয়েকজনের নাম নিচে উদ্ধৃত করা হল:

১.  ইবনে সাদ হযরত আয়শা (রা.) এবং হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রা.) থেকে নকল করেছেন যে, রাসূল (সা.) ১২ই রবিউল আউয়াল ইন্তেকাল করেছেন। [তবাক্বাতে ইবনে সাদ, ২/২৭২]

২. হাফেজ যাহাবী রহঃ ও তাই বলেন। [তারীখে ইসলাম লিয যাহাবী, ৫৬৯]

৩. হাফেজ ইবনে কাসীর (রহ.) ও একই কথা নকল করেছেন। [আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৫/২৫৫]

৪. ঐতিহাসিক ইবনে আসীর (রহ.)ও তাই লিখেছেন। [আসাদুল গাবাহ-১/৪১, আলকামেল, ৪/২১৯}

৫. ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.)ও ১২ই রবিউল আউয়াল ইন্তেকালের কথা বলেছেন। [ফাতহুল বারী, ১৬/২৬১]

৬. মুহাদ্দিস ইবনে হিব্বান (রহ.)-এর মতও তাই। [আসসীরাতুন নাবাবিয়্যাহ লিইবনে হিব্বান, ৪০৪]

৭. ইমাম নববী (রহ.) একই কথা বলেছেন। [শরহে মুসলিম]

৮. ঐতিহাসিক ও মুফাসসির ইবনে জারীর তাবারী (রহ.) ১২ই রবিউল আউয়াল ওফাতের কথা উল্লেখ করেছেন। [তারীখে তাবারী-৩/২০৭]

৯. ইমাম বায়হাকী (রহ.)-এরও একই রায়। [দালায়েলুন নবুয়্যাহ-৭/২২৫]

১০. মোল্লা আলী কারী (রহ.)ও এই ফায়সালাই দিয়েছেন। [মিরকাত শরহে মিশকাত, ১১/১০৪]

১১. সীরাত বিশেষজ্ঞ মাওলানা শিবলী নূমানী ও তাই ফাতাওয়া দিয়েছেন। [সীরাতুন নবী, ২/১৮৩]

১২. কাযী সুলাইমান মানসূরপূরী একই কথা বলেছেন। [রাহমাতুল্লিল আলামীন-১/২৫১]

১৩. আর রহিকুল মাখতুমের লেখক সফিউর রহমান মুবারকপুরীও তাই বলেন। [আর  রহিকুল মাখতুম, ৭৫২]

১৪. মাওলানা আবুল হাসান আলী নদবীও তাই লিখেছেন। [আসসীরাতুন নববিয়্যাহ, ৪০৪]

১৫.  আহমাদ রেজা খাঁ বেরেলবীও তাই ফায়সালা করেছেন। [মালফুযাতে আহমদ রেজা]

এবার পাঠকদের কাছে আমার জিজ্ঞাসা: পৃথিবীর কোন ধর্মের মূল ব্যক্তির মৃত্যু দিবসে তার প্রকৃত অনুসারীদের কখনো আনন্দ উল্লাস করতে দেখেছেন? নাকি সেই মহান ব্যক্তিত্বের শত্রুরা আনন্দ উল্লাস করে থাকে?

রাসূল (সা.)-এর মৃত্যুর দিনে কোন ব্যক্তি আনন্দ করতে পারে না। আনন্দ করতে পারে কেবল শয়তা, আর তার দোসররা।

রাসূল (সা.)-এর মৃত্যুর খবর শুনে সেদিন সাহাবাগণ বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। যে যে-ই স্থানে ছিল, সেখানেই নিথর হয়েছিল। চোখ দিয়ে বয়েছিল অশ্রুর বন্যা।

আর নিশ্চয় শয়তান হাসছিল। বগল বাজাচ্ছিল। ইহুদি-খ্রিস্টানরা আর মুশরিকরা হাসছিল। মনে মনে আনন্দে নাচছিল।

ঠিক একই কাজটাই কি করা হচ্ছে না রাসূল (সা.)-এর মৃত্যু দিবসে?

৯০ ভাগ মুসলমানের রাষ্ট্রে আমাদের মহান নবির মৃত্যু দিবসে এভাবে জশনে জুলুস বের করে আনন্দ করা, হুল্লোড় করা, মিষ্টি বিতরণ করা, আনন্দ র‌্যালি বের করা দেখেও রাসূল (সা.)-এর সাচ্চা অনুসারীরা কি করে চুপ করে বসে থাকে? আমাদের রাসূল প্রেম গেল কোথায়?

যে ব্যক্তি নিজের মায়ের মৃত্যু দিবসে আনন্দ উল্লাসের আয়োজন করতে পারে না। মন সাড়া দেয় না। নিজের সন্তানের মৃত্যু দিবসে আনন্দ করতে পারে না। স্বজনের মৃত্যু দিবসে আনন্দ র‌্যালি বের করতে পারে না। সেই ব্যক্তি কি করে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের শ্রেষ্টতম সৃষ্টি, যাকে সমগ্র জগতের জন্য রহমতস্বরূপ আল্লাহ তা'আলা প্রেরণ করেছেন, যাঁর নাম আমাদের কালিমার অংশ। যাঁর নাম না বলে কবরে মুক্তি নেই, হাশরের ময়দানে যাঁর সুপারিশ ছাড়া উপায় নেই। যাঁর হাতে হাউজে কাউসারের পানি পান করা ছাড়া আমাদের গত্যন্তর নেই।

সেই নবীজী (সা.)-এর মৃত্যু দিবসের দিন কতিপয় নবির দুশমন আনন্দ র‌্যালি বের করবে, আনন্দ উল্লাস করবে, ঈদের আনন্দ করবে। এটি কি করে একজন নবী প্রেমিক বরদাশত করতে পারে? কি করে মিষ্টি বিতরণ করতে পারে?

সাড়ে চৌদ্দশত বছর আগে ১২ই রবিউল আউয়ালে আমাদের প্রিয় নবির ইন্তেকালের এ দিনে সাহাবারা ছিলেন  অশ্রুসজল। আর ইবলিশ ছিল হাস্যোজ্জ্বল। সাহাবাগণ ছিলেন কান্নারত আর ইবলিস এবং ইহুদি-খ্রিস্টানদের ছিল ঈদের দিন।

আজ সাড়ে চৌদ্দশত বছর পর এসে সেই ইবলিস এবং ইহুদি-খ্রিস্টানদের ঈদ আমাদের দেশে পালিত হয় মহা আড়ম্বরে। কতিপয় নবির দুশমনদের এ দৌরাত্ম্য কি এতটাই বেশি হয়ে গেছে যে, এমন ভয়াবহ নবি দুশমনদের প্রতিহত করার মত ঈমানী শক্তি কোন নবীর আশেকের নেই?

আমি কার কাছে যাব? কার কাছে মাতম করবো? কার কাছে বিচার জানাবো? এ কেমন জুলুম ভাই? এ কেমন অবিচার ভাই? তুমি তোমার মায়ের মৃত্যু দিবসে ঈদ করতে পারো না। বাবার মৃত্যু দিবসে আনন্দ করতে পারো না। সন্তানের মৃত্যুর দিন মিষ্টি বিতরণ করতে পারো না, তাহলে তোমার পরিবারের চেয়েও কি আমার নবি কম মুহব্বতের হয়ে গেল? কি করে এসব নবির আশেক দাবি করে রাসূল (সা.)-এর মৃত্যু দিবসে আনন্দ উল্লাস আর ঈদ পালন করতে পারে এ নবিবিদ্বেষীরা?

জন্মের খুশিতে ঈদ পালন নয়, রোযা রাখাই আমার নবির শিক্ষা।

আবু কাতাদা আনসারী (রাযি.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন: একদা রাসূল (সা.) কে তাঁর সোমবারে রোযা রাখার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হল, [কারণ রাসূল (সা.) সোমবার দিন রোযা রাখতেন] তখন রাসূল (সা.) [কারণ দর্শাতে গিয়ে] বলেন যে, এদিন আমি জন্ম নিয়েছি, আর এদিনই আমার উপর কুরআন নাজিল হয়েছে। [তাই আমি শুকরিয়ার নিমিত্তে রোযা রাখি]

[সহিহ মুসলিম,হাদীস নং-২৮০৭
সুনানে আবু দাউদ,হাদীস নং-২৪২৮
সুনানে বায়হাকী [কুবরা],হাদীস নং-৮২১৭
সহীহ ইবনে খুজাইমা,হাদীস নং-২১১৭
মুসনাদে আবি আওয়ানা,হাদীস নং-২৯২৬
মুসনাদে আহমাদ,হাদীস নং-২২৫৫০]

আমরা লক্ষ করলেই দেখতে পাবো, রাসূল (সা.) আমাদের এই হাদিসে কী চমৎকার একটি শিক্ষা দিলেন। সেটা হলো- জন্মের খুশিতে রোযা রেখে আল্লাহর শুকরিয়া জানানো, এই কাজে আনন্দ- উল্লাস করা মুসলমানের কাজ নয়।
আর আমরা জানি, ঈদের দিন রোযা রাখা হারাম, যা নাকি বহু হাদিসে সরাসরি উল্লেখ আছে। যদি নবীজী (সা.)-এর জন্মদিনটা ঈদের দিন হতো, তাহলে নবীজী (সা.) নিষিদ্ধ রোযা রাখলেন কেন? রাসূল (সা.)-এর রোযা রাখার মাধ্যমে এটাই শেখালেন যে, এটা কোন ঈদের দিন নয়। আনন্দ উল্লাসের দিন নয়, বরং শুকরিয়া জানিয়ে রোযা রাখার দিন।

নবির জন্মদিন পালন হল খ্রিস্টানদের কালচার, মুসলমানদের নয়। বরং মুসলমানদের কালচার হলো শুকরিয়া হিসেবে রোযা রাখা। তাই আসুন, সত্যিকার অর্থে নবির সুন্নাতের পাবন্দির মাধ্যমে নবিকে ভালোবাসি। কথিত “জশনে জুলুশে ঈদে মিলাদুন্নবি” পালন করে ঈমান বিধ্বংসী মারাত্মক বিদআতে শরীক না হই। আল্লাহ তায়ালা আমাদের বুঝার তৌফিক দান করুন। আমীন।

তথ্যসূত্র: আহলে হক্ব বাংলা মিডিয়া সার্ভিস

dainikamarbangla

সর্বশেষ খবর

হাইলাইটস

বিশেষ সংবাদ